তানভীর আহমেদ, টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ফিরে::
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। এখানকার নীল জল, আকাশে সাদা মেঘ ও সবুজ হিজল-করচ গাছের সারি যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে তোলে। বর্ষায় নৌকাভ্রমণের সময় চারপাশের গ্রামগুলোর সাধারণ জীবনযাত্রা ও হাওরের সৌন্দর্য এক নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয় পর্যটকদের। কিন্তু হাওরে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনে দিনদিন বাড়ছে ঝুঁকি।
শুক্রবার ও শনিবার (২২ ও ২৩ আগস্ট) দুইদিন টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (শুক্রবার) অন্তত শতাধিক হাউসবোট প্রবেশ করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ হাউসবোট হাওরের সারিবদ্ধ হিজল-করচ গাছের সাথে বেঁধে রাখতে দেখা যায়। অনেকসময় বাতাসে হাওরে ঢেউ উঠলে সেই ঢেউয়ের কারণে গাছের সাথে হাউসবোটের ধাক্কা লাগে, আর এতে ভাঙ্গছে গাছের ডাল-পালা। অন্তত ৫০টি হাউসবোট ঘুরে দেখা গেছে, হাউসবোটগুলোতে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, বয়া, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নেই। আবার অনেক হাউসবোটে কেবল নামমাত্র কিছু লাইফ জ্যাকেট রাখা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। তবে, স্থানীয় ছোট-বড় ইঞ্জিনচালিত নৌযানে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
এছাড়া, প্রাথমিক চিকিৎসার কিট থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ হাউসবোট ও স্থানীয় পর্যটকবাহী নৌকায় এগুলোর উপস্থিতি দেখা যায়নি। এমনকি, জরুরি পরিস্থিতিতে যাত্রীদের নিরাপদ রাখার জন্য প্রশিক্ষিত কোনো কর্মীও নেই। আবার, অধিকাংশ হাউসবোটে ছাদে বা জানালার পাশে কোনো ধরনের সুরক্ষা রেলিং নেই, যা হাওরে আসা পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অভিযোগ, এসব হাউসবোটে নেই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা নিরাপদ সেফটি ট্যাংক। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মানববর্জ্য সরাসরি হাওরের পানিতে মিশে যাচ্ছে, যা জলজ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এতে করে একদিকে যেমন পানির গুণগত মান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে হাওরের জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। কর্তৃপক্ষের নজরদারি এবং তদারকির অভাবে হাউসবোট মালিকরা পরিবেশের এই ক্ষতি অবাধে চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি অনেক হাউসবোটের নেই রেজিস্ট্রেশনও। এদিকে, হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এখানকার আশপাশের গ্রামের মানুষজন। দিনদিন হাওরের পানি ‘নোংরা’ হওয়ায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা।
স্থানীয় জেলে রবিন মিয়া বলেন, আগে আমরা যে পরিমাণ মাছ পেতাম, এখন তার ১০ ভাগও পাই না। পানি নোংরা হওয়ায় মাছের রোগ হচ্ছে, অনেক মাছ মরেও যাচ্ছে। মাছ একেবারে নেই বললেই চলে। শুধু মাছ নয়, হাওরের পানি ব্যবহারকারী স্থানীয় মানুষজনও বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। শীঘ্রই এই বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সংকটাপন্ন এই হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় পর্যটকদের সচেতনতার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। যেখানে পর্যটকদের জেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার, লাইফ জ্যাকেট পরিধান, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হতে বিরত থাকা, দূর থেকে পাখি ও প্রাণী পর্যবেক্ষণ করা, ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তোলা, স্থানীয় গাইড ও পরিষেবা গ্রহণ, ক্যাম্পফায়ার বা আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়াও কিছু বিষয় বর্জন করতে বলা হয়েছে। সেগুলো হলো, উচ্চ শব্দে গান-বাজনা করা/শোনা যাবে না। হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলা যাবে না। মাছ ধরা, শিকার বা পাখির ডিম সংগ্রহ করা যাবে না। পাখিদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে কোন ধরনের বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু বা রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না। গাছ কাটা, গাছের ডাল ভাঙ্গা বা বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যাবে না। কোর জোন বা সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা যাবে না। মনুষ্য সৃষ্ট জৈব বর্জ্য হাওরে ফেলা যাবে না। কিন্তু এইসব নিয়মনীতি যেন কাগজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করা হলেও অবাধে প্রতিদিন প্রবেশ করছে অন্তত ২ শত ছোট-বড়, মাঝারি সাইজের নৌকা। আবার কখনো কখনো ওয়াচ-টাওয়ারের নিকটবর্তী এলাকায় হাউসবোট প্রবেশ করছে। নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা আছে, হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলা যাবে না। কিন্তু প্রতিনিয়তই হাওরে প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলেছেন অসচেতন পর্যটকরা। আর, হাওরের পানিতে গোসল করতে নেমে শ্যাম্পু ব্যবহার করছেন না, এই দৃশ্য খুবই কম চোখে পড়বে। হাউসবোট ও ছোট নৌকাগুলো গাছের সাথে বেঁধে ভাঙ্গা হচ্ছে হিজল করচ গাছের ডাল-পালা। আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় স্থানীয়রা গাছ ও গাছের ডাল কেটে তা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। মাছ ধরা নিষেধ থাকলেও কারেন্ট জাল, খাঁড়া জাল, ভাসা জাল, প্লাস্টিকের চাঁই, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ নানান ধরনের নতুন প্রযুক্তিতে মাছ শিকার করা হচ্ছে। যা হাওরের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
এদিকে, হাওরে উচ্চ শব্দে গান-বাজনা করা বা শোনা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও তা কখনোই মানছেন না পর্যটকরা।
শুক্রবার দুপুরেও একদল তরুণর ওয়াচ-টাওয়ার সংলগ্ন স্থানে ছোট একটি ইঞ্জিন চালিত নৌযানে ঢাক-ঢোল, গিটার বাজিয়ে উচ্চ শব্দে গান গাইতে দেখা যায়। হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায় বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শুধুমাত্র প্রশাসন একা কাজ করে কিছুই করতে পারবে না। প্রশাসনকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। সবাই মিলে কাজ করলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। একই সাথে হাওরে আসা পর্যটকদের সচেতন থাকতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। এই টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের সম্পদ, এটি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান মানিক বলেন, হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। আমি কিছুদিন হয় দায়িত্ব নিয়েছি, শীঘ্রই হাওরের এসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিবো।
জেলা প্রশাসক ড. মো. ইলিয়াস মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের সম্পদ। তাই হাওরে এমন কোনো কিছু করা যাবে না যাতে প্রকৃতি, পরিবেশ ও হাওরের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। এটি আমরা হতে দেব না। এ জন্য সবার সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
শৃঙ্খলা ফিরছে না টাঙ্গুয়ার হাওরে
- আপলোড সময় : ২৬-০৮-২০২৫ ০৯:২০:৫৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৬-০৮-২০২৫ ০৯:২৫:৩২ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ